ইলিশ খেতে মাওয়া

ইলিশ খেতে মাওয়া যেতে হবে কেন?-পাঠক এ প্রশ্ন তুলতেই পারেন। আসলেই তো ইলিশ মাছ খেতে কেনো মাওয়া ঘাটে যেতে হবে ! যখন আমাদের নাকের ডগার সামনেই  বিস্তর ইলিশ মাছ তাদের চকচকে দেহ নিয়ে শুয়ে আছে। দামও বেশ সস্তা। কেজি মাত্র ৭০০ টাকা। একটু মূলোমুলি করলে হযতো   ৬৫০ টাকায়   ঠেকতে পারে। কেটে ধুয়ে মশলা মেখে সরিষাতেলে কড়া ভেজে নিলেই হলো। সাথে যদি বেগুন ভাজা আর সাথে শুকনো মরিচ ভাজা-তাহলে তো কথাই নেই। চেটে-পুটে খেয়ে  দুপুরে ভাত-ঘুম। আহ! জীবন কতো সুন্দর। ইলিশ মাছ আর বাঙালী-দুজনে দুজনার।  

ইদানিং একটা হুজুগ চলছে। হুজুগটির নাম ‘আউটিং’। অনেকেরই  সপ্তাহের শুরু থেকেই মনটা উড়ু উড়ু করে । কাজে  তেমন মন বসে না। পকেটে মাল তেমন নেই-তাতে কি হয়েছে, ক্রেডিট কাড আছে না! ধার করে হলেও ঘি খাওয়া আমাদের অভ্যাস। চলে যাই মাওয়া অথবা ঢাকার পাশে গাজীপুরের কোন রিসোর্টে । যাক না কিছু টাকা খসে। সরকারী-বেসকারী ব্যাংকের লোকেরা তো ধার দেওয়া জন্য বসেই আছে। 

 বউ অনেকদিন থেকে ঘ্যানর ঘ্যানর করছে মাওয়া যাবার জন্য। মাওয়া যেয়ে  ইলিশ খাবে। সবাই নাকি মাওয়া যেয়ে ইলিশ খাচেছ মচমচ করে। আমি কৌশলে এড়িয়ে যাই ।  কিন্তুু শেষ রক্ষা আর হলো না। যেতেই হলো। গত ১৬ই ডিসেম্বর ২০২০ বউ,বাল-বাচ্চা, শ্যালিকা, শ্যালিকার  অধাংগ ও তাদের এক বছর বয়সী পূঁচকে মেয়ে সহ রওনা হলাম ।  সাথে লোক বেশী বলে প্রাইভেট গাড়ী নেওয়া গেলো না। মিরপুর ১২ নং থেকে স্বাধীন নামক বাসে শওয়ার হলাম  সকাল দ’শটার দিকে। বিজয় দিবস বলে রাস্তা-ঘাট বেশ ফাঁকা। ছোট ছোট পতাকা দিয়ে সজ্জিত দালান,দোকান ঘাট,তোরণ। বাতাসে হাল্কা শীতের আমেজ। বাস বিভিন্ন স্টপেজে থামছে আর যাত্রী তুলছে। বিরক্তির একশেষ! ঢাকা মাওয় রোড়ের কথা কি বলিব ভাই! এরকম রাস্তা বাপের জন্মে দেখেননি, এটা বলতে পারি। যাই হোক, মাওয়া এসে গেলো।

মাওয়া পুরানো ঘাট পেরিয়ে  আমরা এলাম নতুন ঘাটে ( শিমুলিয়া)। ঘাটে দাড়ালে বেশ দুরে পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হয়।ঘাটে ট্রলার যাতায়াত করছে। আগ্রহীরা পয়সার বিনিময়ে ট্রলারে চেপে পদ্মা সেতুর পিলারে চারদিকে চক্কর মেরে আসছে।ট্রলারের বাধা রেট নেই, ঘন্টা প্রতি ১০০০ থেকে ২০০০ টাকা। আমার কাছে বেশ চড়াই মনে হলো। অনেককে দেখলাম, দরদাম না করেই ট্রলার ভাড়া করলো-পদ্মা সেতু বলে কথা। ফেইসবুকে স্টেটাস দিতে হবে না ! সামনে দাঁত কেলানো  আমি  আর পেছনে পদ্মা সেতু-এই স্টেটাসের দাম যে লাখ টাকা !

সব রেস্টুরেন্ট এখন শিমুলিয়া ঘাটে। রাস্তার দু’পাশে সারি সারি রেস্তোরা। প্রত্যেকটা রেস্তোরার সামনে প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেলের জটলা। সুন্দর পোষাকে সজ্জিত নাগরিকরা। ছেলেরা পান্জাবী,নারীরা শাড়ি। গালে আল্পনা । শিশুদের হাতে লাল-সবুজ পতাকা ।  ঢাকা বা আশে-পাশের এলাকা থেকে ইলিশ-প্রেমিক,ভোজনরসিকরা চলে এসেছে ।রেস্টুরেন্টরে সামনে বেয়ারেদের হাঁক-ডাক। এই যে তাজা ইলিশ খাইতে চাইলে-এইদিকে। বাতাসে ইলিশ ভাজার মৌ-মৌ গন্ধ। চিত্ত ব্যাকুল। নাসিকায় চুলবুল। কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়! 

রাধঁনী হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট । ভিতরে বেজায় ভীড়। কেউ ঢুকছে,কেউ বের হচ্চছ। কোন টেবিল খালি নাই। দোকানের সামনে  বিশাল দুটি তাওয়ার একটিতে গোল বেগুন চাকা চাকা করে আর একটিতে ইলিশ মাছের পিছ ভাজা হচ্চছ সরষে তেলে।  নীচে একটা পাত্রে মশলা মাখানো মাছ। পিছ হিসাবেও বিক্রি হয়। আমরা লোক বেশী। দুটো দেড় কেজি ওজনের মাছ কিনতে হলো ২০০০ টাকায়। আমাদের সামনেই মাছ কাঁটা,ধোয়া আর মশলা মাখানো হলো। শ্যালিকা আর জামাইকে পাঠালাম সিট দখল নিতে। মাছ ভাজার সাথে অবশ্যই লেজ-ভর্তা আর ইলিশের ডিম ভাজি নিলাম। আমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে ইলিশ ভাজা দেখছি আর ও দিকে আমার লোকেরা পিলো-পাসিঙের মতো সিট দখল নিতে ব্যস্ত। একসময় টেবিলে মাছ ভাজা,লেজ-ভর্তা আর ডিম ভাজি দিয়ে গেলো মেচিয়ার। সব সামনে নিয়ে বসে আছি, কিন্তুু ভাত আসার নাম নেই। ভাত শর্ট পড়েছে। নতুন করে রান্না চড়িয়েছে।ধোঁয়া উঠা গরম গরম ভাত আসলো। আধা ঘন্টা লাগলো না,চেটে পুটে শেষ করতে। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে না তুলতেই দেখি, মাথার পিছনে জটলা। সবাই দাড়িয়ে আছে সিট দখল করার জন্য। কি আর করা! খাওয়ার পর আয়েশ করা হলো না।আসন ছাড়তে হলো পরবর্তী খাদ্যরসিকদের জন্য।

এবার আসল কথা বলি, মাওয়ার ইলিশের চেয়ে ঢাকার বাজারে উঠা ইলিশ আমার কাছে অনেক উপাদেয় লাগে। শুধু চোখ-কান খোলা রেখে মাছ কেনার সঠিক আর্ট রপ্ত করতে হবে। মাওয়া যেয়ে ইলিশ খেতে হবে, এটা মনে হয় আমাদের নিছক বাহানা। আসলে ঘোরাঘুরিটাই আসল উদ্দেশ্য। রথও দেখা হলো আবার কলাও বেচা হলো। পরিবারে সবার মন আনন্দে ভরে গেলো-এটাই বা কম কিসের।


 

0 Response to "ইলিশ খেতে মাওয়া"

Post a Comment